টোকিওর এক শপিং মল থেকে চমৎকার একটা মানিব্যাগ কিনেছি। এত পছন্দ হলো জিনিসটা, হোটেলে এসে নেড়েচেড়ে দেখি মানিব্যাগে লেখা মেড ইন বাংলাদেশ।
গর্বে বুক ভরে গেল। আমার দেশের চামড়া শিল্পও পৌঁছে গেছে জাপানে! সঙ্গে জাপানের এনএসকে রেডিওর কর্মী সাওরি তাকাহাসি ছিল। সে বলল, তুমি কি জানো এই মুহূর্তে জাপানের বিখ্যাত মডেলদের একজন তোমাদের বাংলাদেশি মেয়ে?
আমি সেই মেয়ে এবং তার বাবাকে চিনি। মেয়েটির শিশু বয়সের অনেকগুলো বছর বাংলাদেশে কেটেছে। তার পর থেকে সে জাপানে। জাপানের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, খবরের কাগজ, এমনকি বাস-ট্রেনেও সেই মেয়ের ছবি। বিশাল বিলবোর্ডজুড়ে আছে আমাদের মেয়েটি। তার মুখের দিকে তাকালে নিজের দেশ নিয়ে অহংকারে বুক ভরে যায়। মনে মনে বলি, তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
সারা বিশ্বের বড় বাজারগুলো দখল করে আছে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প। এই তো কিছুদিন আগে নরওয়ে-সুইডেন হয়ে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমেরিকার প্রতিটি শপিং মল আলোকিত করে আছে বাংলাদেশের পোশাক। নরওয়ে সুইডেনের শপিং মলগুলো বাংলাদেশি জামাকাপড়ে ভর্তি। সুইডেনের চারটি শহরে গেছি। স্টকহোম, উপসালা, গোটেনবার্গ, মালমো। যেকোনো শহরে গেলে আমি প্রথমে বইয়ের দোকানে যাই। তারপর যাই শপিং মলে। প্রতিটি শপিং মলেই আছে মেড ইন বাংলাদেশ লেখা প্রচুর জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি। ‘গোটেনবার্গ বুক ফেয়ার’ উপলক্ষে বাংলাদেশি লেখকের বই বেরিয়েছে সুইডিশ ভাষায়। সেই বই হাতে নিয়ে আমি মনে মনে বলি, তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
মালমোর একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। এক যুবক এসে বিনীত ভঙ্গিতে সামনে দাঁড়াল। মালমোতে আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।
মালমোতে বাংলাদেশি যুবক চমৎকার রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে। ব্যাপক সুনাম তার রেস্টুরেন্টের। উপসালায়ও ওরকম একটি রেস্টুরেন্ট দেখেছি, দুই বন্ধু মিলে বহু বছর ধরে চালায়। ওই রেস্টুরেন্ট এক টুকরো বাংলাদেশ।
বিদেশের শপিং মলে সাজানো বাংলাদেশি পোশাকের দিকে তাকালে বা স্পর্শ করলে মন অন্য রকম হয়ে যায়। কোথায় কত দূর পৌঁছে গেছে আমার দেশ!
কোটির ওপর বাঙালি কাজ করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া শহরের রাস্তায় হাঁটছি। সঙ্গে আরো দু-তিনজন। পার্কের ভেতর থেকে এক যুবক ছুটতে ছুটতে এলো। আমি আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়াবই।
এরকম হূদয়াবেগ আর কোন জাতির হবে বাঙালি ছাড়া! সেই যুবক আমাকে বলেছিল, মালয়েশিয়া দেশটি তৈরিই করে দিল বাঙালিরা। আমি তাকে বলেছিলাম, আমাদের দেশটিও আমরাই তৈরি করছি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
বাঙালি আজ নানা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রাখছে। বাংলাদেশকে এখন পৃথিবী চেনে বহু কারণে। আমাদের ক্রিকেট টিম পৃথিবীর প্রতিটি বড় দলকে হারিয়েছে। ক্রিকেট বিশ্ব বাংলাদেশ টিমকে এখন সমীহের চোখে তো দেখেই, ভয়ও পায়। বাংলাদেশ যখন যে ক্ষেত্রে বিজয়ী হয় আমি মনে মনে বলি, তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
খবরের কাগজের লোকদের ছুটিছাটা কম। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে এক দিনের ছুটি পেয়েছিলাম। কালের কণ্ঠ’র উপদেষ্টা সম্পাদক অমিত হাবিব, নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল এবং আমি ঠিক করলাম কত দূর এগোল স্বপ্নের পদ্মা সেতু, দেখতে যাব।
আমি প্রায়ই ওই এলাকায় যাই। মাওয়ার আগের গ্রাম মেদিনীমণ্ডলে আমার নানাবাড়ি। ছেলেবেলার অনেকগুলো বছর কেটেছে সেই গ্রামে। যাওয়া-আসা, যোগাযোগ আছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর সময় থেকে বহুবার গেছি। অমিত, কামাল কখনো যায়নি। মাওয়ায় সুন্দর একটি রিসোর্ট হয়েছে, মাওয়া রিসোর্ট। অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশ, পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকার সুন্দর সুন্দর কটেজ, রেস্টুরেন্টটির খাবার অসাধারণ। ফুল-ফলের গাছপালায় ভর্তি, ছবির মতো এক টুকরো সবুজ ঘাসের মাঠ আর মাঝখানে বিশাল এক দিঘি। দিঘিভর্তি মাছ। আমরা নয়নকে সঙ্গে নিলাম। তার পুরো নাম সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন। আমাদের ইভেন্ট এডিটর এবং শুভসংঘের পরিচালক। তিনটি হুইল বড়শি, সোহেল নামের একজন মাছ ধরার সহকারী এবং নানা স্বাদের চার নিয়ে সেও আমাদের সঙ্গে। বেড়ানোর ফাঁকে যদি দু-একটা মাছও ধরা যায়।
অনেক চার ফেলে, অনেক চেষ্টা-তদবির করে দুটো ছোট সাইজের মৃগেল নয়ন ধরতে পেরেছিল।
মাওয়া রিসোর্টের একজন মালিক এবং পরিচালক আলী আকবর। মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি। অত্যন্ত প্রাণবন্ত হাসিখুশি এবং দিলদরিয়া মানুষ। আমরা গেছি শুনে দুপুরের দিকে তিনি রিসোর্টে হাজির। খানিক পর এলেন মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন খান। তিনি ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি, এলাকায় প্রচুর কাজ করছেন। মাওয়া মেদিনীমণ্ডল এলাকাকে মাদকমুক্ত করার কাজে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। ইউনিয়নের প্রতিটি স্তরে তাঁর চোখ, প্রতিটি স্তরকে তিনি উন্নত করতে চান। আশরাফের মতো সৎ-কর্মঠ মানুষই তো বাংলাদেশের জন্য দরকার।
সকাল থেকে আমাদের সঙ্গে আছেন কালের কণ্ঠ মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি মাসুদ খান। সমকাল প্রতিনিধি ইমতিয়াজ, আলী ভাইয়ের ভাগ্নে লোটন, আমার মামাতো ভাই মনির। সব মিলিয়ে বেশ একটা বড় দল। বিকেল ৪টার দিকে পদ্মাতীরে দেখি আলী ভাইয়ের স্পিডবোট রেডি। অমিত, কামাল এবং আমাকে নিয়ে আলী ভাই চড়লেন বোটে। মাসুদ আর ইমতিয়াজও আছে সঙ্গে। প্রথমে আমরা নদী শাসনের কাজটা দেখতে চাইলাম। স্পিডবোট চলল যশলদিয়া এলাকার দিকে। যেতে যেতে দেখছি নদীতীরজুড়ে বিশাল বিশাল সিমেন্টের ব্লক, বালুর বস্তা। বড় বড় বার্জ থেকে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে নদীতে, নদীর লেয়ার ঠিক করার জন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে এই কাজ। আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। তারপর আমাদের বোট ঘুরে গেল পদ্মা সেতু এলাকার দিকে। আমরা তিনজন দাঁড়ালাম স্পিডবোটের সামনের দিকটায়। পদ্মার হাওয়া আর ঢেউ ভেঙে বোট ছুটছে ওপারের জাজিরা উপজেলার মাঝিকান্দির দিকে। পদ্মার এদিক-ওদিকে বিশাল বিশাল ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ড্রেজার আর নানা রকমের যন্ত্রপাতি। আমরা এগোই আর ধীরে ধীরে বড় হয় পদ্মা সেতুর পাইলগুলো। কোনো কোনো পিলারের তিনটি, কোনো কোনোটিতে ছয়টি পাইল জেগে আছে। জাজিরা পয়েন্টের ৪১ নম্বর পিলারের কাছে চলে এলাম। দূরে চরের ওপর রঙধনুর ভঙ্গিতে ড্রেজারের পাইপ থেকে বালুমিশ্রিত পানি পড়ছে। নদীতীরে নানা রকমের ভারী যানবাহন থেকে মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ চলছে। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।
বোট ঘুরে গেল শিমুলিয়া ঘাটের দিকে। ওদিকটায় পদ্মা সেতু কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। যেতে যেতে দেখি ৩৭ ৩৮ ৩৯ এই তিনটি পিলার। এ পিলারেই পদ্মা সেতুর দুটি সুপারস্ট্রাকচার বসতে যাচ্ছে শিগগিরই। ঢালাইয়ের জন্য প্রস্তুত পিলার। একটিতে লোড দেওয়া হয়েছে। লোড ধরে রাখতে পারবে কি না, পরীক্ষা চলছে।
শিমুলিয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়ল নদীতে নোঙর করা আছে চীন থেকে সদ্য আমদানি করা বিশাল সাদা রঙের ক্রেন। এই ক্রেনের ধারণক্ষমতা ৩৬০০ কিলোজুল। তীরে পদ্মা সেতুর একটি সুপারস্ট্রাকচার তৈরি করে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কালভার্ট। আসলে ওই সুপারস্ট্রাকচার জোড়া দিয়ে লোড টেস্ট করা হচ্ছে। সাদা ক্রেন দিয়ে এই সুপারস্ট্রাকচারটি তুলে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হবে পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর। এভাবেই আগামী জানুয়ারিতে প্রথম স্ট্রাকচার দৃশ্যমান হবে। তারপর একের পর এক সুপারস্ট্রাকচার উঠবে পিলারে। চারটি সুপারস্ট্রাকচার ইতিমধ্যে চলে এসেছে চীন থেকে। কাজও চলছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমাদের যেন ঘোর লেগে গেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো এমন স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া কর্মযজ্ঞ ঘটবে বাংলাদেশে, কে কবে ভাবতে পেরেছে? ওই এলাকার দিকে তাকালে মনে হয় আমরা যেন এক নতুন বাংলাদেশ দেখছি। এক বিস্ময়কর বাংলাদেশ দেখছি!
বিশাল সূর্যটি অস্ত যাচ্ছিল পদ্মার পশ্চিমে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছিল নদীর অনেক ওপর দিয়ে। সেই ঘোরলাগা অসাধারণ সন্ধ্যা হয়ে আসা আলোয় আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল এই অসামান্য উপহার বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধুকন্যা, আপনাকে সালাম। সালাম বাংলাদেশ।